তারেক রহমান, উখিয়া
এক সময়ের জিলাপি বিক্রেতা আবু বক্কর। গ্রামবাসীর কাছে ‘বক্কর বাড়ুয়া’ নামেই পরিচিত ছিলেন তিনি। কিন্তু সীমান্তঘেঁষা এলাকায় বসবাসের সুযোগ কাজে লাগিয়ে তিনি যে এক সময় ভয়ংকর মাদক সাম্রাজ্যের নেপথ্য নায়ক হয়ে উঠবেন, তা কল্পনা করেননি কেউ। আজকের বক্কর আর সেই সাধারণ বেকার যুবক নন- তিনি এখন কক্সবাজারের উখিয়া-ঘুমধুম সীমান্তজুড়ে ইয়াবা সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রক, যাকে স্থানীয়রা চেনেন ‘ইয়াবা বক্কর’ নামে।
ঘুমধুম ইউনিয়নের বেতবুনিয়া গ্রামের বাসিন্দা মৃত হোছেন আহমদের ছেলে আবু বক্করের উত্থান গল্পকথার মতোই। প্রথমে সীমান্তের কাছাকাছি বসবাস করার সুযোগে চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত হন। ধীরে ধীরে বক্কর গড়ে তোলেন ১৫–১৬ জনের একটি সংঘবদ্ধ মাদক সিন্ডিকেট। বিজিবি ও পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে আজও সেই সিন্ডিকেট সক্রিয় রয়েছে বলে একাধিক সূত্র দাবি করেছে।
জানা গেছে, গত বছরের ১৩ আগস্ট সন্ধ্যায় উখিয়ার মরিচ্যা চেকপোস্ট থেকে ৭ হাজার ৫০০ পিস ইয়াবাসহ বক্কর ও তার চার সহযোগীকে আটক করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। মামলা হয়, বক্কর জেলে যান। কিন্তু দুই মাসের মধ্যেই জামিনে বেরিয়ে আসেন। অভিযোগ রয়েছে, বেরিয়ে এসেই পুরোনো ব্যবসায় ফেরেন তিনি।
স্থানীয় সূত্র বলছে, বক্করের অনুপস্থিতিতেও তার সিন্ডিকেট মাদক পাচার চালিয়ে যায়। জেলে থাকলেও নির্দেশনা পৌঁছে যেত তাঁর বিশ্বস্ত সহযোগীদের কাছে। এখন জামিনে মুক্ত বক্কর আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছেন সীমান্তজুড়ে মাদক চালান নিয়ন্ত্রণে।
বক্করের সিন্ডিকেট সম্পর্কে মুখ খুলতে চান না এলাকাবাসী। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাসিন্দা বলেন, ‘যারা মুখ খোলে, তাদের হুমকি দেওয়া হয়। অনেক সময় আক্রমণও চালানো হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিমাসে বক্কর একটি বড় চালান নিজেই ঢাকায় নিয়ে যান। সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন জেলায়।’
স্থানীয় ব্যবসায়ী ও শিক্ষক মহলের মতে, এলাকার তরুণদের একটি অংশও এই সিন্ডিকেটের ছত্রছায়ায় দ্রুত আয় ও মোটরসাইকেল–স্মার্টফোনের লোভে জড়িয়ে পড়ছে মাদকে। কিন্তু কেউ প্রকাশ্যে কিছু বলার সাহস পায় না।
সীমান্তপথে ইয়াবা পাচার বন্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনার কথা জানায় বিজিবি। ঘুমধুম এলাকায় নিয়োজিত বিজিবির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বিভিন্ন চোরাচালান রুটে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। যাদের নাম উঠে এসেছে, তাদের বিষয়ে তদন্ত চলছে। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়।’
তবে স্থানীয় প্রশাসনের নীরবতা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন সচেতন মহল। তারা বলছেন, বক্কর ও তার সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় সক্রিয়। মাঝে মধ্যে কিছু অভিযান হলেও স্থায়ী সমাধান নেই। বরং জামিনে বেরিয়ে তারা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
অনুসন্ধান বলছে, সীমান্ত হয়ে আসা ইয়াবার চালান প্রথমে স্থানীয় রোহিঙ্গা ক্যাম্প বা পাহাড়ি গুদামে জমা হয়। এরপর নিরাপদ সুযোগে রাজধানীমুখী পাঠানো হয় সেগুলো। পুরো চেইনের নেতৃত্ব দেন বক্কর। সেই চালান পৌঁছে যায় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, এমনকি সীমান্ত পেরিয়ে ভারত পর্যন্ত।
জিলাপি বিক্রেতা থেকে মাদক সাম্রাজ্যের গডফাদার- বক্করের এই উত্থান কেবল ব্যক্তিগত গল্প নয়, বরং সীমান্তবর্তী অঞ্চলে আইনের ফাঁকফোকর এবং প্রশাসনিক দুর্বলতার বড় এক চিত্র। স্থানীয় মানুষ আজও আতঙ্কে মুখ খুলতে পারেন না। বক্করের মতো অপরাধীরা যতদিন আইনের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এসে পুনরায় অপরাধে যুক্ত হতে পারবে, ততদিন এই চক্র ভাঙা কঠিন হবে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
অবৈধ টাকার দাপটে বক্কর এখন এক বেপরোয়া ও হিংস্র চরিত্রে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি তিনি নিজের অপকর্ম নিয়ে প্রশ্ন তোলায় ক্ষিপ্ত হয়ে এক স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীর ওপর প্রকাশ্যে অতর্কিত হামলা চালান। এলাকাবাসীর মতে, কেউ তার বিরুদ্ধে মুখ খুললেই সেই একই পরিণতির শিকার হচ্ছে- ভয়ভীতি, হুমকি, কিংবা সরাসরি শারীরিক হামলা। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নীরবতা যেন তার এই বেপরোয়া আচরণে আরও সাহস জুগিয়ে চলেছে।
এ বিষয়ে জানতে অভিযুক্ত আবু বক্করের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রশ্ন শুনেই ক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া জানান। সাংবাদিক ও গণমাধ্যম সম্পর্কে অশ্রাব্য ভাষায় মন্তব্য করেন। তাঁর বিরুদ্ধে উঠা নানা অভিযোগ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি এমন আচরণ করেন, যা প্রকাশ করা অনুচিত ও অগ্রহণযোগ্য।