নিজস্ব প্রতিবেদক :
যখন সূর্য ঢলে পড়ে কক্সবাজারের পাহাড়ি শিবিরে, তখন হাজারো তাঁবুর ভেতর থেকে উঠে আসে এক চাপা দীর্ঘশ্বাস। এ দীর্ঘশ্বাস কেবল ক্ষুধা বা অনিশ্চয়তার নয়—এটা হচ্ছে পরিচয়ের, ঘরের, এবং একটা জাতির হারিয়ে যাওয়ার কান্না। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী যেন এক বিস্মৃত মানুষদের দল, যাদের ভূমি আছে, ইতিহাস আছে, কিন্তু নেই নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা কিংবা ন্যায্য মর্যাদা। তাদের প্রতিটি দিন যাচ্ছে এক অনিশ্চিত জীবন ও প্রয়োজন সংকট দুর্ভোগে।
পরিচয়হীন জাতি
রোহিঙ্গারা যুগ যুগ ধরে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বসবাস করলেও সে দেশ কখনো তাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। বরং সময়ের পর সময় তাদের ওপর চলে নিপীড়ন, দমন-পীড়ন, গণহত্যা। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরিপ্রেক্ষিতে যা ঘটেছে, তা ইতিহাসের পাতায় আরেকটি 'জাতিগত নির্মূলের' দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। যেটি বিশ্ব মানবতার দরবারকে নাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশ সেই সময় উন্মুক্ত হৃদয়ে তাদের আশ্রয় দিয়েছিল। কিন্তু আশ্রয় মানেই সমাধান নয়। আশ্রয় কখনো স্থায়ী ঠিকানা হয় না। আজ সাত বছর পর, সেই অস্থায়ী আশ্রয়ই হয়ে উঠেছে তাদের চিরকালীন অনিশ্চয়তার প্রতিচ্ছবি।
জাতিগত সংকট থেকে আঞ্চলিক সংকটে
এই শরণার্থীদের উপস্থিতি এখন আর শুধু একটি মানবিক ইস্যু নয়—এটি পরিণত হয়েছে একটি কূটনৈতিক, নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সংকটে। স্থানীয় মানুষের জীবিকা, প্রাকৃতিক সম্পদ, আইন-শৃঙ্খলা—সব কিছুতেই এর প্রভাব পড়ছে। আন্তর্জাতিক অনুদানও এখন আর আগের মতো নেই। ফলে সঙ্কুচিত সহায়তা নিয়ে চলছে দিনাতিপাত, আর তারই ছায়ায় গজিয়ে উঠছে হতাশা, অপরাধ আর চরমপন্থার সম্ভাবনা।
সমাধান কি শুধু প্রত্যাবাসন?
প্রত্যাবাসনের কথা বলা হয় প্রায়ই, কিন্তু সেই প্রত্যাবাসনের পথে কাঁটাই কাঁটা। মিয়ানমার আজও নিরাপদ নয়, বরং সেখানে সামরিক শাসনের থাবায় জর্জরিত পুরো দেশ। স্বেচ্ছা, নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের যে শর্ত—তা আজও দূর অস্ত। অন্যদিকে বাংলাদেশও এই বোঝা বহন করে ক্লান্ত। তাই প্রয়োজন একটি আন্তর্জাতিকভাবে বাধ্যতামূলক রাজনৈতিক সমাধান—যেখানে জাতিসংঘ, প্রতিবেশী রাষ্ট্র এবং বৃহৎ পরাশক্তিরা প্রকৃত ভূমিকা রাখবে।
রোহিঙ্গার চোখে ভবিষ্যৎ
একটি শিশুর চোখে দেখা যায় কেবল বালুর মধ্যে দৌড়ানো, কাঁধে ঝোলানো খাদ্য কার্ড আর শূন্য দৃষ্টির মা। তার কোনো জন্মনিবন্ধন নেই, শিক্ষা নেই, স্বপ্ন নেই। সে বেড়ে উঠছে একটি 'অস্থায়ী বাস্তবতা'তে, যেখানে স্থায়ীত্ব নেই, দিশা নেই। এই অস্থায়ী বাস্তবতা কতকাল চলবে? এই প্রশ্নের জবাব আজ দরকার বিশ্ববাসীর কাছে, মিয়ানমারের কাছে, এবং আমাদের নিজেদের কাছেও। কারণ প্রতিটি ঘরহীন শিশুর চোখে লেখা থাকে একটাই কথা— "আমারও একটি দেশ ছিল, ছিল একটি পরিচয়।"
স্থায়ী সমাধান: শুধু প্রত্যাবাসন নয়, বহুমুখী রূপরেখা প্রয়োজন
রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান নিয়ে আমরা প্রায়শই একটি কথাই শুনি— "প্রত্যাবাসনই একমাত্র পথ"। অথচ বাস্তবতা বলছে, প্রত্যাবাসনের পথ বহু বছর ধরে স্থবির। তাই এখন সময় এসেছে “এক মাত্রায়” নয়, বরং “বহু মাত্রিক” সমাধান নিয়ে ভাবার।
১.আঞ্চলিক রোহিঙ্গা পুনর্বাসন পরিকল্পনা
একটি বড় কৌশল হতে পারে একটি আঞ্চলিক পুনর্বাসন পরিকল্পনা। যেখানে মিয়ানমার, বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ড মিলে আন্তর্জাতিক সহায়তায় রোহিঙ্গাদের নিরাপদ অঞ্চলভিত্তিক পুনর্বাসনের রূপরেখা তৈরি করবে। এতে করে পুরো বোঝা একটি দেশের ওপর থাকবে না। আগ্রহী রোহিঙ্গারা ঐচ্ছিকভাবে পুনর্বাসনের বিকল্প পাবে।
২.রোহিঙ্গাদের জন্য ‘স্বশাসিত নিরাপদ অঞ্চল’ মডেল
মিয়ানমারের ভেতরেই আন্তর্জাতিক সংস্থার তত্ত্বাবধানে একটি বা একাধিক নিরাপদ স্বশাসিত অঞ্চল গড়ে তোলা যেতে পারে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী দিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত। নিজস্ব স্থানীয় প্রশাসন ও নাগরিক অধিকার। এতে রোহিঙ্গারা দেশে ফিরে নিজভূমিতে থাকলেও আন্তর্জাতিক সুরক্ষার ছায়ায় থাকবে।
৩.রোহিঙ্গাদের পরিচয় প্রদান ও ডিজিটাল নাগরিকতার ব্যবস্থা
বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের জন্য বায়োমেট্রিক আইডি, ডিজিটাল স্বাস্থ্য কার্ড, শিক্ষা সনদ ইত্যাদি চালু করা গেলে তাদের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ সহজ হবে। এ ব্যবস্থাপনায় তাদের পরিচয় থাকবে, অপরাধমূলক কাজে ব্যবহারের সুযোগ কমবে। ভবিষ্যতের জন্য নাগরিকতার দাবি বা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির ভিত্তি হবে।
৪.অন্তর্বর্তী স্বেচ্ছাসেবী নগরী গঠন
বিশ্বের কিছু অংশে দেখা গেছে, অস্থায়ীভাবে শরণার্থীদের জন্য স্বতন্ত্র মানবিক নগরী গড়ে তোলা হয়। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার অর্থায়নে। যেখানে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও সামাজিক ব্যবস্থা থাকে আলাদাভাবে। এটি রোহিঙ্গাদের নিজস্ব সমাজ গড়ে তুলতে সহায়তা করবে, এবং অপরাধ বা চরমপন্থা থেকেও দূরে রাখবে।
৫.রোহিঙ্গা নেতৃত্ব গড়ে তোলা ও আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে তাদের কণ্ঠস্বর
রোহিঙ্গাদের পক্ষে আন্তর্জাতিক মহলে যারা কথা বলেন, তারা প্রায় সবাই বাইরের লোক। এখন সময় এসেছে রোহিঙ্গা শিক্ষিত যুবকদের নেতৃত্বে আনা,
আন্তর্জাতিক ফোরামে অংশগ্রহণ করানো, নিজ জনগোষ্ঠীর জন্য তারা যেন নিজেই দাবিদার হতে পারে। এতে করে সমাধানের কথাবার্তা বাস্তবমুখী ও প্রতিনিধি হয়।
৬.বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ‘টেকসই সহাবস্থান নীতিমালা’
যেহেতু সংকট দীর্ঘমেয়াদি হচ্ছে, তাই বাংলাদেশ সরকারকে প্রয়োজন একটি রোহিঙ্গা সহাবস্থান নীতিমালা। যেটা রোহিঙ্গা শিবিরের ব্যবস্থাপনা, স্থানীয় জনজীবনে প্রভাব, নিরাপত্তা এবং মানবিক সেবা—সব কিছু কাঠামোবদ্ধভাবে সংজ্ঞায়িত করবে। এই নীতিমালা আন্তর্জাতিক দাতাদেরও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে।
শেষ কথা: আশার সীমানায় দাঁড়িয়ে
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জীবনে যেন এক অনিঃশেষ অন্ধকার। নির্বাসিত এই মানুষেরা হারিয়েছে তাদের ভিটেমাটি, ইতিহাস, এমনকি পরিচয়ের অধিকারও। কিন্তু প্রতিটি দীর্ঘ রাতের শেষে যেমন সূর্য ওঠে, তেমনি এই সংকটেরও একদিন হবে অবসান—এটাই আমাদের বিশ্বাস, আমাদের প্রতিশ্রুতি। তবে সমাধান যদি কেবল দূর আকাশে ভাসমান স্বপ্ন হয়, তবে তা কখনো বাস্তবের মাটিতে নামবে না। দরকার সাহসী কূটনীতি, মানবিক ঐক্য এবং ন্যায়বিচারের অঙ্গীকার। রোহিঙ্গাদের চোখের কোণে জমে থাকা দীর্ঘশ্বাস একদিন আনন্দের বৃষ্টিতে ধুয়ে যাবে, যদি আমরা আজ তাদের জন্য সুবিচার নিশ্চিত করতে পারি।
এটি কেবল রোহিঙ্গাদের লড়াই নয়—এটি মানবতার পরীক্ষা, সভ্যতার দায়। যে দিনে এক নিষ্পাপ রোহিঙ্গা শিশু তার মায়ের কোলে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখবে, "আমারও একটি দেশ আছে, আছে একটি ঠিকানা," সেদিনই হয়তো আমরা সত্যিকারের সমাধানের দোরগোড়ায় পৌঁছাবো।